Description
ধরুন, দশ বছর আগের কোনো মফস্সল শহরের অনেক বিষাদমাখা ম্লান বিকেলবেলার কথা তাঁর কবিতায় অনুবাদ করে রেখেছিলেন একজন কবি। আর আপনি, দশ বছর পর, আবার সেই কবিতার বইয়ের কাছে ফিরে এসেছেন শুধু তার পাতার ভাঁজে ভাঁজে যে নরম আলো, যে মনখারাপের উদাসী হাওয়া জমাট বেঁধে আছে, তাকে আর একবার ছুঁতে চাইছেন বলে। তাহলে কী নাম হবে সেই বইয়ের? সেই বইয়ের নাম “উট-পালকের ডায়েরি”, আর কবির নাম কিশোর ঘোষ। কিশোরের এই বইটির প্রথম প্রকাশ ২০০৯; দশ বছর পার করে ২০১৯-এ এসেও মগ্ন পাঠক যে এই বইটিকে খুঁজে নেন, তার কিছু স্বকীয়তা তো অবশ্যই থাকবে! “উট-পালকের ডায়েরি”-র স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে তা ছবিতে কথা বলে। আর সেই সব ছবিতে জড়িয়ে থাকে মফস্সলের রাস্তাঘাট, ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকার, জমিয়ে রাখা প্রেমের চিঠি, হারিয়ে ফেলা সম্পর্ক, আর একজন রোম্যান্টিক কবির অসহায় বেঁচে থাকা। এ-সবই এই কবির লেখার বিষয়। আর এদেরকে কিশোর প্রকাশ করেন ছেঁড়া ছেঁড়া ছবির মধ্যে দিয়ে। কিশোর লেখেন, “টুং… ঘণ্টা পড়ে বিছানায় /স্বপ্ন থেকে উঠে কিছুটা দূরের মোড়ে / কে অপেক্ষা করে! / যশোর রোড দিয়ে ভারী ট্রাক ছুটে যায়… / রাত হয়েছে / আবছা একটা গাছ… / চাঁদ গলে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে এ পাড়ায় / গাছটা ভাল করে দ্যাখো— কাণ্ড ও পাতার অড়ালে / জানলায় ব’সে / কে চিঠি লেখে? /-এদিকে আমরা দু’জন / পূবে ও পশ্চিমে ঘুরে ঘুরে / সীমান্তে ক্যাম্প ফ্যালে বাতাস আরোহী—/ টুং… / ঘণ্টা পড়ে বিছানায় / দুটো বালিশের মাঝখান দিয়ে / ভারী ট্রাক ছুটে যায়…” কবিতার শুরুতে ও শেষে ওই টুং ধ্বনিটির অব্যর্থ ব্যবহার খুব সূক্ষ্মভাবে জানিয়ে দেয় কীভাবে সামান্য একটি এসএমএস-এর বয়ানে একটি প্রেমের গল্পের শুরু এবং সমাপ্তি লেখা হয়ে যায়। দুটো বালিশের মাঝখান দিয়ে একটি ট্রাকের ছুটে যাওয়ার কর্কশতা পড়ে থাকে শুধু।
দশ বছরে তিনবার মুদ্রণ হয়েছে এই বইটি। বোঝা যায় এ বইয়ের ব্যক্তিগত যে স্টাইল সেটা অধিকাংশ পাঠক পছন্দ করেন। কবিতাগুলি ভালো লাগার অন্যতম কারণ এটাই যে খুব সহজ ছবিতে এই বিষণ্ণতার যাপন আঁকা আছে এখানে। তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে “সন্ধ্যা”, “রাত্রি”, “ডানা”, “রিকশা”, “হাওয়া”, “চিঠি”, এই সব শব্দেরা। মনোযোগী পাঠক বোঝেন যে কিশোর আসলে একটা চলে যাওয়া সময়, একটা রাস্তা, বা হয়তো হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কদের কথাই বলতে চাইছেন তাঁর নিজস্ব প্রকাশে। আর এই প্রকাশ যতটা মৃদুভাষ, ততটাই মগ্ন। সে কথা বলে খুব নীচু স্বরে। কিন্তু তার প্রকাশ এমনই যে তা পাঠকের অন্তঃস্থল সহজেই ছুঁতে পারে। কিশোর লেখেন, “শুধু রাত্রি, সারিবদ্ধ কৃত্রিম বাতিদান… / অথচ নাছোড় কিছু আলোর পোকা… / আর সব / ঘর-বাড়ি-কলকারখানা… জেগে থাকা নির্জনতা / হয়তো কে, কোন জানলা ঘেঁষে / পুরোনো জ্যোৎস্নার… চিঠি খুলে পড়ছে / সত্যি ঘুমিয়েছে? / ঘুমের ভিতরে… ওরা জেগে আছে কারা!” “উট-পালকের ডায়েরি”-র প্রথম অংশ যতটা প্রেম আর বিষাদের অনুষঙ্গে ভরা, পরবর্তী অংশ ততটাই মনোজ্ঞ ও দার্শনিক প্রশ্নে আকীর্ণ। এই পর্বের নাম, “অন্ধকারে, তারাদের পাড়ায়”। এই পর্বে কিশোর অভিমান আর বিষাদের থেকে বেশ কিছুটা সরে এসেছেন। এখানে তিনি অনেকটাই আত্মস্থ। ব্যক্তিগত না-পাওয়ার থেকে অনেকটা দূরে এসে তিনি ক্রমশ চারপাশের জগৎকে অনুভব করতে চাইছেন। আর এভাবেই মফস্সলের সহজ জীবন ছাড়িয়ে তাঁর কবিতায় চলে আসছে মহাবিশ্বের আরও সব প্রাণী, উদ্ভিদ, আর খনিজের কথা। তিনি লেখেন, “মানুষের বুকের ভিতর অনেক অলিখিত / চিঠি পড়ে আছে— সেই / চিঠির ভিতর অনেক রঙের / বোবাশব্দ পড়ে আছে— সেই / শব্দগুলোর ভিতর-সমুদ্রের, আকাশের, মাটির / অরণ্যের মতো / অনেক অক্ষর পড়ে আছে— সেই / সমুদ্রে-বহু ঝড় তুফান মাছের সাঁতার / সেই মাটিতে— বহু খনিজ, জীবানু, ফসলের ভ্রূণ / সেই অরণ্যের ভিতর অনেক বৃক্ষ, গুল্ম, ফুল, ফল, পাখি / আর দাবানল পড়ে আছে… / মানুষ তাকে কখনও পাঠ করেনি!” ব্যক্তিগত বিষাদ থেকে অস্তিত্বের সারাৎসার সন্ধানের যে উপলব্ধি, এটাই শূন্যদশকের কবি কিশোর ঘোষের কবিতাকে অন্য স্তরে নিয়ে যায়।
Additional information
Weight | 0.35 kg |
---|---|
Dimensions | 17 × 13 × 0.76 in |
Author | |
Binding | |
Page Count | |
ISBN | |
Edition |
Reviews
There are no reviews yet.